ভারতীয় সঙ্গীত পৃথিবীর সব চাইতে প্রাচীন সঙ্গীত। ধর্মের সঙ্গে এর নিবিড় বন্ধন। আধ্যাত্মিক সম্পদ যেমন আমরা ধর্মীয় শাস্ত্রগুলির মধ্যে পাই, তেমনি পাই আমাদের সঙ্গীতে। এই সঙ্গীত বিনা মন্দিরে দেবদেবীর আরাধনা সম্পূর্ণ হত না। এখনো তার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে। দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যকলার উৎস হলেন ঈশ্বর। ভারতে মুসলমান আক্রমণের আগে সারা ভারতবর্ষে একই প্রকারের সঙ্গীতশৈলী প্রচলিত ছিল। কিন্তু তারপর মুসলমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ভারতীয় সঙ্গীতে প্রচুর পরিবর্তন দেখা দিতে লাগল। দক্ষিণ ভারতে এই আক্রমণ তেমন ছাপ ফেলতে পারে নি। সেই কারণে তারা তাদের ঐতিহ্য অনেকটাই বজায় রাখতে পেরেছিল। কিন্তু উত্তর ভারতের কাহিনী অন্যরকম। মুসলিম প্রভাবে জনজীবনে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটতে থাকে। দেশের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তি টলে যায়। আর ভারতীয় ধর্মসাধনার যে প্রধান অঙ্গ সঙ্গীত, তার চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। উপরন্তু, পারস্য দেশ থেকে নিয়ে আসা সঙ্গীতের সঙ্গে মিশে যায় প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীত। এই সঙ্গীতের মূল কথা ছিল ভক্তি, সেই সম্পদ আর বজায় রাখা যায় নি। এই মিশ্রণের ফলে জন্ম নেয় আধুনিক হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। এর গতি প্রকৃতি একেবারেই ভিন্ন।
ভারতে মুসলমান আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত মোটামুটি একই প্রকারের সঙ্গীতশৈলী প্রচলিত ছিল। মনে রাখতে হবে যে, আজকের পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সেকালে ভারতবর্ষের অঙ্গীভূত ছিল। অবশ্য চিরকালই বহু রাজত্বে বিভক্ত ছিল। এই দেশ কোনদিনও এক পতাকাতলে সমবেত ছিল না। তা সত্ত্বেও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একটি সাম্যভাব লক্ষ্য করা যায়। সারা ভারতবর্ষে উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত সঙ্গীত একই ধারায় প্রবাহিত হত বলে মনে হয় — যাকে প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীত অথবা হিন্দু সঙ্গীত বলা যেতে পারে। এই সঙ্গীত ছিল প্রধানত মন্দির-কেন্দ্রিক ও তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেবসেবা। কোনও দেবদেবীর আরাধনা সঙ্গীত বিনা সম্পূর্ণ হত না। ব্রাহ্মণ শ্রেণীর উপর দায়িত্ব ছিল এই সঙ্গীতের চর্চা, শুদ্ধতা রক্ষা, গুরু-শিষ্য পরম্পরায় শিক্ষাদান ও সঙ্গীত শাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ রচনা। অতএব দেখা যায়, ধর্ম ছাড়া সঙ্গীতের কথা ভাবা যেত না। মন্দির ও তার পুরোহিত শ্রেণীর আর্থিক এবং অন্যান্য দায়িত্ব নিতেন দেশের রাজা। সুতরাং মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত সঙ্গীতবিশারদ ব্রাহ্মণেরা জীবন উৎসর্গ করতেন সঙ্গীত সাধনায়। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কোন আর্থিক বিনিময় থাকত না; বিশুদ্ধ রীতি বজায় রাখা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য এই সঙ্গীত রক্ষিত হওয়ার প্রথা ছিল। নানা কারণে সঙ্গীতশাস্ত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
আমার এই লেখায় আমি কোনো বিশদ বিবরণের মধ্যে যাচ্ছি না কারণ সাধারণ পাঠক ভারতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে তেমন আগ্রহী নাও হতে পারেন। গল্পচ্ছলে লিখলে তা হয়তো তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে।
আমরা আশাকরি বোঝাতে পেরেছি যে মুসলমান আক্রমণের পরবর্তী সময়ে ভারতে দুটি ভিন্ন সঙ্গীত পদ্ধতির অস্তিত্ব চোখে পড়ে। দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীত ও উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত। দক্ষিণ ভারতীয় বা কর্ণাটিক সঙ্গীতধারা হয়তো বা প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতের ছায়া বহন করে। আর উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত, যাকে আমরা সাধারণ ভাবে হিন্দুস্থানী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বলে জানি, তা কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি। একদিকে সুরের ক্ষেত্রে সেই সময়ে প্রচলিত ভারতীয় রাগসমূহের সঙ্গে পারসিক সঙ্গীত থেকে আসা মোকামগুলির অবাধ মিশ্রণ ঘটতে আরম্ভ করে। স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় রাগের রূপবর্ণনার রীতি ও পরিবেশনগত পদ্ধতিতেও প্রভূত পরিবর্তন আসতে থাকে। যেমন, পূর্বকালে রাগের পরিচায়ক হিসাবে মূর্ছনার গুরুত্ব ছিল। কিন্তু হিন্দুস্থানী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করল রাগে ব্যবহৃত স্বরগুলির আরোহণ, অবরোহণ ও পকড়। পকড় শব্দটি বিদেশী। এর অর্থ হলো যথাসম্ভব কম স্বর ব্যবহারের মাধ্যমে রাগের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশটিকে প্রকাশ করা। পণ্ডিত ভাতখণ্ডের বিখ্যাত সঙ্গীত-সঙ্কলন গ্রন্থ ‘ক্রমিক পুস্তক মালিকা’য় এই নতুন প্রথাটির অজস্র উদাহরণ মেলে। অপরদিকে পূর্বকালে রচিত সঙ্গীতশাস্ত্র গ্রন্থগুলিতে মূর্ছনা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
আমাদের আগ্রহ জাগে যে কি ধরণের গীতরীতি মুঘল বাদশাহের দরবারে পরিবেশিত হত; তাদের অনুষঙ্গ যন্ত্রই বা কি প্রকারের ছিল। প্রথম দিকে ধ্রুপদ নামে এক প্রকার প্রবন্ধ শ্রেণীর গীতশৈলী সর্বাধিক সম্মানের আসনে ছিল। বহু পূর্বে এই ধ্রুপদ ছিল লৌকিক সঙ্গীত। তার বিবর্তনের ইতিহাস যথেষ্ট জটিল। বীণা ও মৃদঙ্গ প্রাচীন ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র। সম্ভবত এইগুলি অনুষঙ্গ যন্ত্র হিসাবে প্রচলিত ছিল। পরে কখনো ইতিহাসের প্রসঙ্গে যাব। এই শ্রেণীর সঙ্গীতের উৎস ছিল ভারতে প্রচলিত সঙ্গীত।
পরের দিকে খেয়াল গীতরীতি জন্ম নেয় এবং অচিরেই এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে ধ্রুপদ গান তার সম্মান ও গুরুত্ব ক্রমশই হারাতে থাকে। বর্তমান কালেও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে খেয়াল গানই সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত রীতি; ধ্রুপদ গান প্রায় বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাচ্ছে। যাই হোক, খেয়াল একটি পারসিক শব্দ, এর অর্থ হলো কল্পনা। অতএব আমরা ধরে নিতে পারি যে এই গীতরীতির উপর পারস্য দেশের সঙ্গীতের প্রভাব আছে। কল্পনা শব্দটি থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, ধ্রুপদ গানের চাইতে এই গানে গায়কের স্বাধীনতা অনেক বেশি ছিল। ধ্রুপদী সঙ্গীত গাম্ভীর্য-প্রধান, কথার অংশ বিস্তৃত ও গুরুত্বপূর্ণ। সেই তুলনায় খেয়াল গানের রচনা সংক্ষিপ্ত ও পরিবেশনের ভঙ্গী লঘুতর। এই গানের সাধারণ অনুষঙ্গ যন্ত্র সারেঙ্গী ও তবলা। আজকাল হারমোনিয়ামও ব্যবহৃত হয়। এর ইতিহাসও চিত্তাকর্ষক।
আরো কিছু গীতরীতি ছিল কিন্তু সেগুলি এককভাবে রাজদরবারে গীত হত না। এগুলি ছিল হালকা তালে নিবদ্ধ সমবেত কন্ঠের সঙ্গীত। সবচাইতে বিখ্যাত ছিল কাওয়ালি গান যার জনপ্রিয়তা আজও বজায় আছে। সূফী সাধকদের গানেও এই রীতির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। কাওয়ালি নামে একটি তালও জনপ্রিয় ছিল। এটির সঙ্গে কাহারবা তালের মিল আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গানে এই কাওয়ালি তাল ব্যবহার করেছেন। ৬০/৭০ এর দশকে হিন্দী চলচ্চিত্রে এই কাওয়ালি গান তার জনপ্রিয়তার জন্য প্রচুর পরিমাণে শোনা যেত।
এই মিশ্র শ্রেণীর সঙ্গীতের সঙ্গে একটি নাম মিশে আছে। সেই নামটি হল আমীর খুস্রৌ।